ইসলামের দৃষ্টিতে শহীদ যারা

ইসলাম ডেস্ক।। ‘আল্লাহর পথে যারা নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পার না।’ শহীদদেরকে মৃত না বলা তাঁদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের জন্য। পক্ষান্তরে শহীদরা শুধু জীবিতই নয়, বরং তারা কবরে রিজিকও পায় বলে ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা-

وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَٰكِنْ لَا تَشْعُرُونَ
“আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়,তাদের মৃত বলো না বরং তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা অনুভব করতে পারো না।” (সূরা বাকারা-১৫৩)

فَلْيُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يَشْرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالْآخِرَةِ ۚ وَمَنْ يُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا
“কাজেই আল্লাহর কাছে যারা পার্থিব জীবনকে আখিরাতের পরিবর্তে বিক্রি করে দেয় তাদের জেহাদ করাই কর্তব্য। বস্তুত: যারা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে এবং অতঃপর মৃত্যুবরণ করে কিংবা বিজয় অর্জন করে, আমি তাদেরকে বিশাল প্রতিদান দান করব।” (সূরা নিসা: ৭৪)

وَ لَا تَحۡسَبَنَّ الَّذِیۡنَ قُتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ اَمۡوَاتًا ؕ بَلۡ اَحۡیَآءٌ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ یُرۡزَقُوۡنَ

আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনোই মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত এবং তাদের রবের কাছ থেকে তারা জীবিকা-প্রাপ্ত হয়ে থাকে।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৬৯)

আয়াতের সারসংক্ষেপ

আর যারা আল্লাহর পথে ধর্মের জন্য নিহত হয়ে গেছে তাদের সাধারণ মৃত ব্যক্তিদের মতো মৃত বলে ধারণা করো না। বরং তারা এক অনন্য জীবনধারায় জীবিত এবং স্বীয় পালনকর্তার কাছে নৈকট্যপ্রাপ্ত অতি প্রিয়পাত্র। তারা রিজিকও প্রাপ্ত বটে।

عن أبي موسى قال : جاء رجل إلى النبي صلى الله عليه وسلم فقال : الرجل يقاتل للمغنم والرجل يقاتل للذكر والرجل يقاتل ليرى مكانه فمن في سبيل الله ؟ قال : ” من قاتل لتكون كلمة الله هي العليا فهو في سبيل الله
আবু মুসা রা. থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “এক ব্যক্তি গনিমতের সম্পদ অর্জনের জন্য জিহাদ করল, একজন নিজের সুনামের জন্য জিহাদ করল, আরেকজন তার বীরত্ব দেখানোর জন্য যুদ্ধ করল। এদের মাঝে কে আল্লাহর আল্লার রাস্তায় যুদ্ধ করল?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান উচ্চকিত করতে যুদ্ধ করল সেই কেবল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করল।” [অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে নিহত হল সেই শহীদ]। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-২৬৫৫, সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-৫০২৯}

অন্য এক হাদিসে এসেছে, হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার সঙ্গে সাক্ষাত হলে বললেন, জাবের, তোমার কি হল! তোমার মন খারাপ দেখছি? আমি বললাম, ওহুদের যুদ্ধে আমার বাবা শহীদ হয়ে গেলেন। তার পরিবার এবং অনেক ঋণ রেখে গেছেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাকে কি আমি তোমার বাবার সঙ্গে আল্লাহ তাআলা কীভাবে সাক্ষাত করেছেন সে সুসংবাদ দেব? আমি বললাম, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা সবার সঙ্গে কথা বলেন পর্দার আড়াল থেকে। কিন্তু তোমার বাবাকে আল্লাহ জীবিত করে সরাসরি কথা বলেছেন এবং বলেছেন, ‘হে আমার বান্দা! আমার কাছে চাও, আমি তোমাকে দেব।’ তিনি বললেন, হে আমার রব! আমাকে জীবিত করে দিন যাতে আমি আবার আপনার রাস্তায় শহীদ হতে পারি। মহান আল্লাহ বললেন, ‘আমার পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত এই যে, এরা দুনিয়াতে পুনরায় ফিরে যাবে না।’ হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তখন এই আয়াত নাজিল হয়।’ (তিরমিজি ৩০১০, ইবনে মাজাহ ১৯০, ২৮০০)

সাঈদ বিন যায়েদ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
من قتل دون ماله فهو شهيد ومن قتل دون أهله أو دون دمه أو دون دينه فهو شهيد
– ”যে ব্যক্তি নিজ সম্পত্তি রক্ষায় নিহত হয় সে শহীদ।
– যে ব্যক্তি নিজ পরিবার রক্ষায় নিহত হয় সেও শহীদ।
– অথবা প্রাণ রক্ষায় কিংবা দ্বীন রক্ষায় নিহত হয় সেও শহীদ।”
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৭৭৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-১৬৫২)

জাবের বিন আতিক রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
الشهداء سبعة سوى القتل في سبيل الله المطعون شهيد والغرق شهيد وصاحب ذات الجنب شهيد والمبطون شهيد والحرق شهيد والذي يموت تحت الهدم شهيد والمرأة تموت بجمع شهيد
“আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করা ছাড়াও সাত প্রকার শহীদ রয়েছে। যথা:
১) প্লেগ বা মহামারীতে মৃত্যুবরণকারী শহীদ।
২) পানিতে নিমজ্জিত হয়ে মৃত্যু বরণকারী শহীদ।
৩) প্লুরিসি (pleurisy বা ফুসফুসের আবরক ঝিল্লির বা পর্দার প্রদাহজনিত রোগবিশেষ) রোগে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তি শহীদ
৪) পেটের রোগে মৃত্যুবরণকারী শহীদ।
৫) অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তি শহীদ।
৬) দেয়াল বা অনুরূপ ধ্বংসাবশেষের নিচে পড়ে মৃত্যুবরণকারী শহীদ।
৭) সন্তান প্রসব করার সময় মৃত্যুবরণকারী নারীও শহীদ।” (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস নং-৫৫৪, ৮০২, আল মু’জামুল কাবীর, হাদিস নং-১৭৮০, সহীহ কুনুজু সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ, হাদিস নং-২৩)
আল্লাহু আলাম।

শহীদদের মর্যাদা

প্রত্যেক মৃত ব্যক্তি আলমে বরযখে বা কবরে বিশেষ ধরণের এক প্রকার হায়াত বা জীবন প্রাপ্ত হয় এবং সে জীবনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কবরের আযাব বা সওয়াব ভোগ করে থাকে। তবে সে জীবনের হাকিকত মানুষ জানে না। যেসব লোক আল্লাহর রাস্তায় নিহত হন, তাদেরকে শহীদ বলা হয়। তাদের মৃত্যুকে অন্যান্যদের মৃত্যুর সমপর্যায়ভুক্ত মনে করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা, মৃত্যুর পর প্রত্যেকেই বরযখের জীবন লাভ করে থাকে এবং সে জীবনের পুরস্কার অথবা শাস্তি ভোগ করতে থাকে। কিন্তু শহীদগণকে সে জীবনের অন্যান্য মৃতের তুলনায় একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদা দান করা হয়।

হাদিসে পাকে এসেছে-হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, আমরা এ আয়াত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘শহীদদের আত্মাকে সবুজ পাখির পেটে রাখা হয়। ফলে তারা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারে। তারপর তারা আরশের নীচে অবস্থিত কিছু ঝাড়বাতির মধ্যে ঢুকে পড়ে। তখন তাদের রব তাদের প্রতি এক দৃষ্টি দিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা কি চাও? তারা বলে হে রব! আমরা কি চাইতে পারি? আমাদের যা দিয়েছেন তা তো আপনি আপনার কোনো সৃষ্টিকে দেননি। তারপরও তাদের রব আবার তাদের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে অনুরূপ প্রশ্ন করেন। যখন তারা বুঝল যে, তারা কিছু চাইতেই হবে, তখন তারা বলে, আমরা চাই আপনি আমাদের দুনিয়ার জীবনে ফেরৎ পাঠান, যাতে আমরা পুনরায় আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে শহীদ হতে পারি। শহীদগণের সাওয়াবের আধিক্য দেখেই তারা এ কথা বলবে- তখন তাদের মহান রব তাদের বলবেন, আমি এটা আগে নির্ধারিত করে নিয়েছি যে, এখান থেকে আর ফেরার কোনো সুযোগ নেই।’ (মুসলিম ১৮৮৭)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *