শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাক্রমের ভবিষ্যৎ

শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, প্রবণতা, সামর্থ্য, অভিজ্ঞতা ও শিখন চাহিদাকে সমন্বয় করে এবং সমাজ, দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে প্রণীত হয় নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রম। শিক্ষার্থী কী শিখবে ও কেন শিখবে এবং তা কিভাবে, কে, কার সহযোগিতায়, কী দিয়ে, কোথায়, কত সময় ধরে শিখবে এবং যা শিখেছে তা কিভাবে মূল্যায়ণ করা হবে এসব প্রশ্নের উত্তর শিক্ষাক্রমে থাকে। শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, শিখনফল, বিষয়বস্তু, শিখন-শেখানো কার্যক্রম ও মূল্যায়ন নির্দেশনা- এসবই শিক্ষাক্রমের প্রতিপাদ্য বিষয়। শিক্ষাক্রমের নির্দেশনার আলোক প্রণীত হয় পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য শিখন- শেখানো সামগ্রী। এ শিক্ষাক্রমকে আবর্তন করেই যেকোনো স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার কর্মকাণ্ড পরিকল্পিত ও পরিচালিত এবং বাস্তবায়িত হয়। ১৯৯৫ সালে শিক্ষাক্রম পরিমার্জিত হয়ে তা বাস্তবায়িত হয় ১৯৯৬ সালে এবং পরবর্তীতে ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তার আলোকে ২০১২ সালে নতুন শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ প্রণয়ন করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ এর কাজ পরীক্ষামূলকভাবে দেশের ৬৩ টি স্কুলে প্রয়োগ করা হয় তারই ধারাবাহিকতায় সারাদেশে ২০২৩ সালে ৬ষ্ঠ ও ৭ম, ২০২৪ এ এসে ৮ম ও ৯ম শ্রেণিতে প্রয়োগ করা হয় যা বর্তমানে চলছে এবং ২০২৫ সালে ১০ম শ্রেণিতে এভাবে ২০২৬ এ একাদশ ও ২০২৬ এ দ্বাদশ শ্রেণিতে এর প্রয়োগ হবার কথা আছে। শিক্ষাক্রম পরিমার্জন, উন্নয়ন ও নবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক পরিবীক্ষণের মাধ্যমে চলমান শিক্ষাক্রমের সবলতা-দুর্বলতা ও উপযোগিতা নির্ণয় করা হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এসবের ফলে শিখন চাহিদাও পরিবর্তিত হচ্ছে। সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক চাহিদার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি অনুসরণ করে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রশাসক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, প্রচলিত শিক্ষাক্রম বিবেচনায় শিক্ষাক্রম উন্নয়নে নিচের ধাপগুলি অনুসরণ করা হয়— ১. অবস্থার  বিশ্লেষণ ও চাহিদা নিরূপণ ২. শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন ৩. বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ৪. শিক্ষাক্রমের সমন্বয় সাধন ও সার্বিক রূপদান ৫. জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি কর্তৃক শিক্ষাক্রম অনুমোদন। যেগুলো সম্পন্ন করে নতুন একটি পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের আউটলুক হিসেবে পাঠ্যপুস্তক আকারে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে সময়সাপেক্ষ। শিক্ষাক্রম কয়েকবার পরিমার্জিত হলেও অভিজ্ঞতানির্ভর ও যোগ্যতাভিত্তিক বর্তমান শিক্ষাক্রম- ২০২২ বিভিন্ন কারণে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। এর মধ্যে—

১. শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা তথা শিক্ষার্থী শিক্ষক অনুপাতঃ দেশের একেকটি ক্লাসে ৬০-১২০ জন করে শিক্ষার্থী রয়েছে যাদের সকলকে মোটিভেট করে একটা ক্লাস ফ্রুটফুলি পরিচালনা করা একজন শিক্ষকের জন্য দুরূহ। যার ফলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী আসল উদ্দেশ্যে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। ২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোঃ বর্তমান কারিকুলাম বলেন আর বর্তমান জামানা বলেন এর কোনোটাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষের অবকাঠামোকে ডিজার্ভ করে না। সেখানে কক্ষ, বেঞ্চ, পানি, বিদ্যুৎ, কম্পিউটার, ল্যাব, কক্ষবিণ্যাস,,,। ৩. শিক্ষকদের আর্থসামাজিক মর্যাদাঃ একটা দেশের মেরুদণ্ড যদি হয় শিক্ষা তাহলে শিক্ষক হলো সেই শিক্ষার মেরুদণ্ড। যে শিক্ষকই আজ নানা জায়গায় বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও অবমানিত; হোক সেটা নিজেদের দ্বারা নতুবা ছাত্র, প্রশাসন, কমিটি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারা। বর্তমান বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয় তা খুবই দুঃখজনক ও লজ্জাজনক। তা আর নাই বা উল্লেখ করলাম। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের কপালে কারো কারো চাকরির গড়ে ১০ থেকে ২৫ বছর পরে একটা প্রমোশন হয়েছে গত ২০২১ সালে এবং গত ২ মাস আগে তাদের মধ্য থেকে নামেমাত্র কিছুসংখ্যককে চলতি দায়িত্বে পোস্টিং দেওয়া হয় যা খুবই হতাশাজনক। তাঁদের অনেকেই রয়েছেন একটা টাইমস্কেল পেয়েছেন আবার কেউ একটাও পাননি। তারপর শিক্ষকদের কারো চাকরির প্রায় ১১/১৩ বছর হয়ে গেছে তাদের না পেয়েছেন কোনো প্রমোশন না পেয়েছেন কোনো সিলেকশন গ্রেড আর না পেয়েছেন কোনো টাইম স্কেল। তাঁদের একটা সুযোগ ছিল সহকারী প্রধান শিক্ষক ও সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে নিয়োগ বিজ্ঞাপনের এগেইনস্টে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আবেদনের এবং সেখানে তাঁদের অনেকেই অনেক স্বপ্ন নিয়ে আবেদন করে। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এইযে ওই বছরই ডিসেম্বরে কোনো এক অজানা কারণে নিয়োগটা স্থগিত হয়ে যায় পরে এক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করলে বলেন আবেদনের টাকা উঠিয়ে নাকি নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে আবার অনেকের এমন একটা ভাব ছিল যে জুনিয়রকে কিভাবে স্যার ডাকবে এরকম প্রবঞ্চনাও শুনা যেত যা আজও তা প্রতীয়মান। আবার অনেকের চাকরির ৪-৭ বছর হয়ে গেছে অথচ উনারা এখনো এডভান্স ইনক্রিমেন্ট পান নি। এসব বঞ্চনার শিকার হলে শিক্ষকের মনোযোগ ডাইভার্ট হবে এবং শিক্ষকতা পেশা গ্রহনযোগ্যতা হারাবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাস্তবতা তুলে ধরাতে কেউ কষ্ট পেলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ৪. বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অপর্যাপ্ততাঃ বর্তমান কারিকুলামে বিষয়গুলো হলো বাংলা(১ম ও ২য় দুইটার অ্যামালগামেটে), ইংরেজি(১ম ও ২য় দুটো মিলে), গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্ম, বিজ্ঞান(পদার্থ, রসায়ন, জীব ও পরিবেশ বিজ্ঞান), জীবন ও জীবিকা, আইসিটি, শিল্প সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এই দশটি বিষয় ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণিতে পঠিত হচ্ছে। কিন্তু বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব লেগেই আছে। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও ধর্ম বিষয়গুলো পরিচালনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের কথা বলা হয়েছে কিন্তু অন্য বিষয়গুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে হয়েছে দুর্গতি। যেমন আইসিটি শিক্ষকের পোস্ট বেসরকারি মাধ্যমিকে থাকলেও সরকারি মাধ্যমিকে সেই পোস্টটা এখনো ক্রিয়েট করা হয় নি। অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন নির্দেশনা যেমন- পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের শিক্ষক বিজ্ঞান পড়াবে সামাজিক বিজ্ঞান পড়াবে ভূগোল ও সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক, জীবন ও জীবিকা পড়াবে কমার্সের শিক্ষক, শিল্প সংস্কৃতি পড়াবে চারুকলার শিক্ষক, আইসিটি পড়াবে আইসিটি বা ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষক বা এই বিষয়ে ভালো ধারণা আছে এমন শিক্ষক। দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে ২৫ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র আছে গড়ে ৫-১০ জন শিক্ষক।  ৫. দেশের তৃণমূল পর্যায়ে কারিকুলামের অপ্রতুলতা গ্রাম বা মফস্বলে না আছে পর্যাপ্ত শিক্ষক আর দক্ষ শিক্ষক তো অমাবস্যার চাঁদ, না আছে শিক্ষকের পর্যাপ্ত ট্রেনিং, না আছে স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপ, বিদ্যালয়ে না আছে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও আইটির সুবিধা। যার দরুন শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকের সমমানের পদগুলো অনেক আগেই ৯ম গ্রেডে উন্নীত হলেও সরকারি মাধ্যমিকের এন্ট্রপদ দশমেই থেকে যায়। অজ্ঞাত কোনো কারণে ২০১৫ সালে সরকারি মাধ্যমিকে এন্ট্রি পদ ৩য় থেকে ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয় ঠিকই কিন্তু গ্রেড চেঞ্জ করা হয় নি এতে করে শিক্ষকগণ আরো হতাশ ও বঞ্চিত হন। ৬. দেশে উদ্ভুত বিভিন্ন পরিস্থিতিঃ পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র থাকা ও নানান দিবস উদযাপনের জন্য শিখন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় নি। বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আবু সাইদসহ তাদের কয়েকশত সহপাঠীর শাহাদাত বরনে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এখনো ট্রমাটাইজড। ৭. কনটেক্সট ও কন্টেন্টগত কারণঃ বর্তমান কারিকুলামের অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনে  বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা বই পেয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে। কোনো কোনো বিষয়ের প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল ছাড়াই সম্পন্ন হয় আর কোনোটা পিডিএফ দিয়ে; শিক্ষক সহায়িকা তো দূরের কথা। শিক্ষক সহায়িকা দেওয়া হলেও সেটা দেরি হয় আবার কেউ কেউ পায়ও নি। আবার হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের কন্টেন্টভিত্তিক নানা সমালোচনা যা সকলেরই জানা। ৮. শিক্ষকের ক্লাসের চেয়ে টিউশনে আগ্রহঃ এটা চিরাচরিত যে পেটে পেলে পিঠে সয়। শিক্ষকরা সমাজে দেখছে তার অবস্থান কেমন আর সমাজ তো সম্মানের চেয়ে অর্থ টাকে সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি হিসেবে ধরে নিচ্ছে। শিক্ষকের যে বেতন হয় তা দিয়ে তাঁর পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। আর কিছু পজিটিভ নেগেটিভ ব্যতিক্রম তো আছেই। প্রাইভেট বা টিউশনির জন্য শিক্ষকরা স্কুলে সিন্ডিকেট করে, ইচ্ছামাফিক রুটিন তৈরি করে নিজেদের মত বিষয় চয়েজ করে পড়ান। সেক্ষেত্রে সকল বিষয়ের শিক্ষকই প্রাইভেট পড়ানোর বাজার অনুযায়ী বিষয় রুটিনে রাখে এতে প্রতিষ্ঠান প্রধান বা রুটিন কমিটিকে কনভিন্স করার জন্য অন্য বিষয় শিক্ষকের এগইনস্টে নানান প্রোপাগান্ডা ছড়ায় এমনকি তাদেরকে আর্থিক বেনেফিট দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না।

৯. অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষ শিক্ষকের অভাবঃ প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষক নেই যেমন- তেমন এক বিষয়ের শিক্ষক অন্য বিষয় পড়ান এতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের বিষয়ভিত্তিক নলেজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ১০. যথোপযুক্ত মনিটরিং ও জবাবদিহিতার অভাবঃ প্রধান শিক্ষক বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সময়োচিত মনিটরিং এর অভাবেও শ্রেণি কার্যক্রম ও মূল্যায়ণ কার্যক্রম যথাযথ হয় না। ১১. মূল্যায়ণ সংক্রান্ত জটিলতাঃ আমরা জানি শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়ণের মাধ্যমে ষাণ্মাসিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ণ সংঘটিত হচ্ছে। গেলো ০৩/০৭/২০২৪ তাং থেকে ৬ষ্ঠ- ৯ম শ্রেণির ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ণ চলতেছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ও বোর্ড কর্তৃক এই মূল্যায়ন স্থগিত করা হয় যার এখনো কোনো আপডেট আসেনি। যে মূল্যায়ণ নিয়ে আছে নানান চ্যালেঞ্জ। মূল্যায়ণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য যথাক্রমে নির্দেশিকা ও প্রশ্নপত্র নির্দিষ্ট বিষয়ের মূল্যায়ণের আগের দিন নৈপুণ্য এ্যাপসে প্রতিষ্ঠান প্রধান তথা এডমিনের একাউন্টে ঢুকে। পরে সেটা শিক্ষকের সংখ্যা অনুযায়ী শিক্ষক নির্দেশিকা ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনুযায়ী প্রশ্নপত্র ডাউনলোডপূর্বক কপি করে প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। পরের দিন তথা সংশ্লিষ্ট মূল্যায়নের দিন শিক্ষক নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট শ্রেণিতে বিষয় শিক্ষক মূল্যায়ণ পরিচালনা করেন। এই আয়োজনগুলো করা হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস আটকাতে। কিন্তু শেষে প্রশ্নপত্রগুলোর ফরম্যাটে চেঞ্জ আনা হয় কিন্তু এরপরও দেখা যায় ফেইসবুক ও ইউটিউবে এগুলো নামে বেনামে কন্টেন্ট আকারে পাওয়া যায় এবং সেগুলোকে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ধারণ করে খাতায় এসে লিখে। ১২. নৈপুণ্য এ্যাপস সংক্রান্ত নানান জটিলতাঃ গেলো বছর ষান্মাসিক ও বার্ষিকের সকল মূল্যায়ণ হাতে প্রস্তুত করা হলেও এবার অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চের দিকে মূল্যায়ণ অ্যাপস পাই যেটা সারাদেশের লগ ইন জনিত জটিলতা নিয়ে কেটে যায় অনেক দিন। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের তথ্য ইনপুট দিতে আছে নানান কথা যেমন কতটুকু অথেনটিক ওয়েতে ইনপুট দেওয়া হচ্ছে না। আবার এই কাজ করতে গিয়ে অনেকক্ষণ স্মার্ট ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ ও মাথা ব্যাথাসহ শারীরিক নানান সমস্যার সৃষ্টি হয়। ১৩. পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক সহায়িকাসহ উপকরণ যথাসময়ে না পাওয়াঃ আগেই বলা হয়েছে প্রশিক্ষণে ম্যানুয়াল, শিক্ষক সহায়িকা, পাঠ্যপুস্তক যথাসময়ে পাওয়া যায় নি। তাই শিক্ষার্থীরা সময়মত রেসপন্স করতে পারে নি। আর বইয়ের কাগজের মান নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। ১৪. শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতাঃ বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন শিখন পরিচালনায় কিছু উপকরণ ব্যবহার করতে হয়। যা অনেক শিক্ষার্থী তা ম্যানেজ করতে পারে না। অভিভাবক সবাই সচেতন না বা আর্থিকভাবে সমর্থ্য নন। আর আবার দলীয় কাজ করাতে গেলেও একজন করে তো ৩ জন দায় এড়িয়ে যায়। আবার প্রতিষ্ঠানও এই উপকরণ সংগ্রহ ও সেগুলো সংরক্ষণ করার জন্য কোনো উদ্যোগ নেয় না। ১৫. শিক্ষকের প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময়সাপেক্ষঃ একটা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের জন্য যেকোনো শ্রেণিতে একটা বিষয়ে একটা সেশন পরিচালনা করার জন্য প্রথমে তাকে শিক্ষক সহায়িকা, অনুসন্ধানী ও অনুশীলন বইয়ের কন্টেন্ট মিলিয়ে দেখতে হয় এবং সে অনুযায়ী পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করতে হয় সেটা খাতায়ই হোক বা পাওয়ারপয়েন্টেই হোক তা কম করে হলেও একটা ক্লাস তৈরি করতে মিনিমাম ৩-৪ ঘন্টা সময় লেগে যায়। আবার একজন শিক্ষকের প্রতিদিন ক্লাস থাকে ৩টা-৬টা। তো বুঝেন ৩ ঘন্টা করে ৩ টা ক্লাস হলেও প্রতিদিন ৯ ঘন্টা ব্যয় করতে হয় শুধু ক্লাসের সেশন প্রস্তুত করতে আবার আছে উপকরণ সংগ্রহ করা। তাহলে দেখা যায় ৯-২০ ঘন্টা লেগে যায় শুধু একদিনের ক্লাস ম্যানেজ করতে। উনার বাকি কাজ কখন করবেন। ১৬. অর্গানাইজড ক্লাসরুমের অভাবঃ বিষয়ভিত্তিক ক্লাস পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক ক্লাস জরুরি কিন্তু দু্র্ভাগ্য হলেও সত্য আমরা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও ক্লাসরুমের অবয়ব পরিবর্তন করতে পারি নি। যে ক্লাসরুম হবে বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন উপকরণে সজ্জিত যেন শিক্ষার্থীরা দেখলেই বুঝতে পারে যে কোনটা গণিত বা ইংরেজির ক্লাস আর কোনটা পদার্থ বিজ্ঞানের ক্লাস আবার কোনটা ধর্মের ক্লাস! ১৭. নৈপুণ্য এ্যাপসে মূল্যায়ণ ইনপুট দিতে শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের স্মার্টফোন না থাকা ও এর দক্ষতার অভাবঃ আমরা দেখেছি বর্তমান কারিকুলামে পিডিএফ ডাউনলোড করা, ইমেইলিং করা, ওয়েবসাইট সার্চ করে একটা নোটিশ বের করা বা নৈপুণ্য অ্যাপস পরিচালনা করার জন্য মিনিমাম দক্ষতা নেই আবার অনেক শিক্ষক বাটন ফোনে অভ্যস্থ তাই স্মার্ট ফোন ব্যবহারে আনইজি ফিল করেন। ১৮. শিক্ষক, গার্ডিয়ান ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের নির্লিপ্ততাঃ উপর্যুক্ত বিভিন্ন কারণে শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীকে স্কুলমুখী করতে পারে না। পরে সে প্রাইভেট পড়ে বা কোচিং সেন্টারের শরনাপন্ন হয় যেটা আরো বেশি জটিল করে তুলে তার শিখনকে কেননা কোচিং-এ শিক্ষকের না আছে প্রশিক্ষণ সেজন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্লাসে শিক্ষকদের পড়ানোর সাথে একটা কন্ট্রাডিক্টরি সৃষ্টি হয়। এসব কারণে বর্তমান কারিকুলাম আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। কিন্তু এরপরও কথা আছে শিক্ষাবর্ষের মাঝখানে এসে হঠাৎ করে যদি বড় কোনো পরিবর্তন করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা আরো হোঁচট খাবে। আবার শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করলেই শিক্ষার্থীদের পড়ায় বসানো যাবে তাও নয়। একটা কারিকুলাম নতুন করে পরিমার্জন করা সময়ের ব্যাপার যা এই মুহুর্তে অসম্ভব। এই শিক্ষার্থীদের নিয়ে গার্ডিয়ান অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। তাই শিক্ষার্থীদের স্বার্থে আমার কিছু প্রস্তাব—-

১. বর্তমান ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ণ যেহেতু বিভিন্ন বিষয়ের বাকি আছে আরো সেজন্য অবশিষ্ট বিষয়গুলোর মূল্যায়ণ মূল্যায়িত বিষয়গুলোর মূল্যায়নের মত করে করা নয়ত নতুন করে আবার সিলেবাস দিয়ে নতুন করে মূল্যায়ণের ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করে সবগুলো বিষয় পূনর্মূল্যায়ণ করা। সেটা লিখিত, মৌখিক, এ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট ইত্যাদির কয়েকটি বা সবগুলো দ্বারা হতে পারে। যা বার্ষিকের শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও তা হতে পারে। এটা এই বছরের জন্য। ২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠান প্রধান কর্তৃক প্রতিটি বিষয়ের জন্য একজন এক্সপার্ট বা রিসোর্স শিক্ষক নির্বাচন করে দেওয়া যিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক্সপার্ট বা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং যিনি নির্দিষ্ট সময় অন্তর(৭/১০/১৫দিন) উক্ত বিষয়ের বাকি শিক্ষকদের শিখন কার্যক্রম ও মূল্যায়ণ মনিটরিং/পরামর্শ/আলোচনাপূর্বক শিক্ষার্থীদের ডেটাগুলো যাচাই করবেন এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতিক্রমে সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। ৩. যতদ্রুত সম্ভব শিক্ষকদের আর্থসামাজিক মর্যাদা উন্নয়ন করা এবং সাথে সাথে তাঁদের ন্যায্য দাবিগুলো পূরণ করা। ৪. শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাস মুখী করার জন্য শ্রেণিকক্ষগুলির ভিতরের অবয়ব যেমন পরিবর্তন করা জরুরি তেমনি শিক্ষাক্রমের যুগোপযোগী সংস্করণ, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, জবাবদিহিতামূলক শিখন কার্যক্রম এবং মূল্যায়ণ প্রক্রিয়া সংস্করণের বিকল্প নেই। ৫. শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণাধর্মী করে গড়ে তুলতে তাদের পিছনে অবশ্যই বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। শিক্ষকদেরকে দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ দিয়ে সেটা প্রয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে। শিক্ষকদের বয়স ৪০+ হলে যোগ্যতা সাপেক্ষে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণার দ্বার অবারিত করা। শিক্ষকদেরকে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অন্য ডিপার্টমেন্ট যেমন শিক্ষা বোর্ড, নায়েম, ব্যানবেইস, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরে কর্মক্ষেত্রে এক্সেস রাখা। ৬. শিক্ষার সকল স্তরে প্রতিষ্ঠান/অথরিটি/সমিতি/কমিটিকে নির্দলীয় করা। কেননা দলীয়করণ করলে শুধু দলের সুবিধা কিন্তু নির্দলীয় করলে শিক্ষার পরিবেশ আন্তর্জাতিক মানের হবে এবং সেটা বিদেশিদের আকৃষ্ট করবে অর্থাৎ বাইরের দেশ থেকে যারা আসবেন তারা এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে আগ্রহী হবে এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেটা সমাদৃত হবে। কেননা বিশ্বে যত নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো নির্দলীয় ও গণতান্ত্রিক। যেটা দলীয় হলে শিক্ষার পরিবেশ যেমনই হোক গুটিকয়েক লোকের সুবিধা হবে কিন্তু শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ থেকে বঞ্চিত হবে। ৭. হাইস্কুল পর্যন্ত স্কুল কেন্দ্রিক এবং বাকি শিক্ষা আত্মনির্ভরশীল বা পেশা নির্ভর হওয়া প্রয়োজন যেন স্কুলগামী একজন শিক্ষার্থী স্কুলেই তার সকল কার্যক্রম শেষ করতে পারে এবং বাকি শিক্ষা গ্রহণ করবে সে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য বা পেশা বাছাই করার জন্য যেন তাকে একদিনও বেকার থাকতে না হয়। ৮. স্কুলে থাকাকালীন সে জীবনভিত্তিক সকল মৌলিক দক্ষতাগুলো অর্জন করতে সক্ষম হবে যেমন ভাষাগত, গাণিতিক, আচরণিক, মানসিক ইত্যাদি যেন সে বড় হয়েও যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো পরিবর্তনে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে তথা অভিযোজনক্ষম ও বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও যেন আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা চালু থাকে সেজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান/শিক্ষক/শিক্ষার্থী/অভিভাবক/অথরিটি/সমিতির জন্য সার্বজনীন বিধিমালা চালু করা যেখানে থাকবে না কোনো দুর্নীতির সুযোগ। ৯. এ সকল কিছু সম্ভব হবে যদি মাধ্যমিক ফর মাধ্যমিক তথা মাধ্যমিকের জন্য আলাদা অধিদপ্তর করা হয়। তাহলে মাধ্যিকের সকল কাজ স্মুথলি সম্পন্ন হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোসহ সংশ্লিষ্ট সকলের জবাবদিহিতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। ১০. ইনক্লুসিভ এডুকেশনকে প্রায়োরিটি দেওয়া এবং সকল ক্ষেত্রে সকল ধরনের শিক্ষাকে শর্তসাপেক্ষে এক্সেসেবল করে দেওয়া।

নূরজাহান বেগম সহকারী শিক্ষক(ভৌত বিজ্ঞান) ব্রাহ্মন্দী কামিনী কিশোর মৌলিক সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নরসিংদী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *