জাহিদুল হাসান জাহিদ,সৈয়দপুর,নীলফামারী।। সাবেক মেয়র আখতার হোসেন বাদলের সহধর্মীনি মেয়র রাফিকা আখতার জাহান বেবীর পরিষদের ১৪ জন কাউন্সিলর দুই বছর পর তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি চালাচালি,সংবাদ সম্মেলন ও জনগণকে নিয়ে বিক্ষোভ আন্দোলন করেন। আবার কাউকে কিছু না জানিয়ে ১৪ কাউন্সিলর তাদের আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান। এ নিয়ে পৌরবাসীর মধ্যে নানা প্রশ্নের উদয় হয়েছে। যে সব কথা মেয়রের বিরুদ্ধে উপস্থাপন করা হয়েছে তার সঠিক সমাধান ১৪ কাউন্সিলর কি পেয়েছেন? না কি ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে এতো সব আয়োজন? ইত্যাদি প্রশ্নের ডানা বেধেছে পৌরবাসীর মধ্যে।
১৪ কাউন্সিলর আনিত মেয়রের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাবী সমূহ সেই সময় বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই সব সংবাদের উপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন।
পত্রিকার সুত্রে জানা যায়, নৈতিক স্খলন, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অদক্ষতার অভিযোগ এনে নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভার মেয়র রাফিকা আকতার জাহান বেবীর প্রতি অনাস্থা জানিয়ে তার অপসারাণের দাবিতে প্যানেল মেয়র সহ পরিষদের ১৪ কাউন্সিলর বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করা সহ সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে। গত ২৩ মার্চ স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব কে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর আগে গত ২০ মার্চ বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বরাবরেও একই আবেদন করেছেন কাউন্সিলররা। স্ব স্ব কার্যালয়ে গিয়ে এই অভিযোগ জমা দিয়েছেন তারা। এই বিষয়ে পৌরবাসীকে অবগত করতে শনিবার (৩০ মার্চ) সংবাদ সম্মেলন করেন ১৪ কাউন্সিলর। সকাল সাড়ে ১১ টায় শহরের ওয়াপদা মোড় এলাকায় ১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র শাহীন হোসেনের অফিসে এই আয়োজন করা হয়। এতে তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেন। বক্তব্য রাখেন ১৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জোবায়দুর রহমান শাহীন, ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিল ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহীন আকতার, ১১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এরশাদ হোসেন পাপ্পু, ১২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল খালেক সাবু প্রমুখ। অন্যান্য কাউন্সিলরদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, প্যানেল মেয়র-২ ও ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ও উপজেলা আওয়ামী মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহানারা বেগম, ১৩, ১৪ ও ১৫ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর রুবিনা সাকিল, ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের মহিলা কাউন্সিলর ইয়াসমিন পারভীন, ১০, ১১ ও ১২ নং ওয়ার্ডের মহিলা কাউন্সিলর ইয়াসমিন সুলতানা, ৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেন, ৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মানিক, ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জোবায়দুল ইসলাম মিন্টু, ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ মঞ্জুর আলম।
এসময় কাউন্সিলররা বলেন, মেয়র রাফিকা আকতার জাহান ‘মেয়র’ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বেলাল্লাপনা চাল চলনে সৈয়দপুরবাসী শঙ্কিত। ২০২৩ সালে তার প্রথম আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তিনি ৪ জন কাউন্সিলরকে সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন যে, এই ভিডিওগুলি সুপার এডিট করা হয়েছে। বছর না ঘুরতেই পুনরায় মেয়র রাফিকার অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ক্লিপ ও ছবিগুলোতে দেখা যায় মেয়র রাফিকা ভিডিও কলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ করছেন। তিনি বিভিন্ন গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অশ্লীল ভঙ্গিতে নাচছেন। আরেক ভিডিওতে দেখা যায় ভিডিও কলের অপর প্রান্তের কারও সঙ্গে বিবস্ত্র হয়ে শরীরের গোপন অঙ্গ প্রদর্শন করছেন। সাধারণ মানুষের প্রশ্নবাণে পৌর পরিষদ জর্জরিত ও বিব্রত। তাছাড়া মেয়র গত ১৩ মার্চ তারিখের বিশেষ (জরুরি) সভার আলোচ্যসূচি নং-০২ মোতাবেক বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিত সৈয়দপুর পৌরসভার নিজস্ব সুপার মার্কেট এর স্টল বরাদ্দের পৌর পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে কার্য বিবরণীতে সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্তকরণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কাউন্সিলরগণের যৌথ স্বাক্ষরে আবেদন করেছিলাম।
মেয়র রাফিকা ৪ জন পি.এস রেখেছেন, যা কখনও তিনি পারেন না। তার আত্মীয়-স্বজন ও গৃহকর্মী ১৫ জনের নামে তিনি নিজেই বেতন উত্তোলন করেন। মেয়রের ব্যক্তিগত গাড়ির তেল ও ড্রাইভারের বেতন পৌরসভা থেকেই গ্রহণ করে থাকেন এবং মেয়র ব্যবহৃত গাড়ি ও ড্রাইভারকে অন্য কোথাও পারিবারিক কাজে ব্যবহারকালীন সময়ে পৌরসভার তেল গ্রহণ করে থাকেন।
এদিকে সৈয়দপুর পৌর এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই বেহাল। বিশেষভাবে তামান্না মোড় হইতে ওয়াপদা মোড় এবং দিনাজপুর রোড বইতে বসুনিয়া বাড়ির মোড় পর্যন্ত খানা-খন্দকে পরিপূর্ণ। পাড়া-মহল্লার রাস্তাঘাটও বেহাল। একজন অদক্ষ, ব্যর্থ মেয়র হিসাবে পৌর এলাকার জন্য কিছুই করতে পারেন নি। পৌরসভার নামীয় সম্পত্তি যাহা চেলু পাম্প নামে পরিচিত সেটি বিগত পরিষদের মামলা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান মেয়র রাফিকা আকতার জাহান মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পুনরায় তাকে লিজ দেন। পৌরসভার বিভিন্ন বহুতল ভবন ও বড় বড় মার্কেটে হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে মালিককে ডেকে রিভিউ কমিটির অনুমোদন ছাড়াই একক সিদ্ধান্তে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কম রেটে ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়। যাহা পৌর আইন পরিপন্থি। সৈয়দপুর পৌর বাজারের নির্মাণাধীন বিভিন্ন দোকান ও মার্কেট নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে চিঠি দ্বারা নোটিশ করা হয়। ৩ দিনের মধ্যে মেয়রের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়। তার পোষ্য দালালদের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পুনরায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য মৌখিক অনুমতি দেয়া হয়। সেই সাথে পৌর বিধি লঙ্ঘন করে মন মর্জি মোতাবেক মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে দোকানের নাম পরিবর্তন করা হয়। উল্লেখ্য যে, যার নাম পরিবর্তন করা হল বছর না ঘুরতেই মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে অন্য কাউকে নাম পরিবর্তন করা হয় (যেমন- ঢাকা টেইলার্স, আবুল খায়েরসহ অন্যান্য দোকান)। মেয়র রাফিকার এহেন অপকর্মের প্রতিবাদে তার পরিবারের সদস্যগণ একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
এমতাবস্থায় মেয়র রাফিকা আকতার জাহানের কুরুচিপূর্ণ ভিডিও ক্লিপ, পৌরসভা পরিচালনে নানান দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং নৈতিক স্খলনে উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ প্রথম শ্রেণি এই পৌরসভার মেয়রকে তার পদ থেকে অপসারণ করার জন্য আমরা কাউন্সিলরগণ যৌথ স্বাক্ষর করে স্থানীয় সরকার পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় ও সচিব মহোদয়কে পত্র দিয়েছি। আমরা আশা করছি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় দৃষ্টান্তমূলক একটি কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। সেই সাথে জাতির বিবেক ও কলম সৈনিক হিসাবে আপনাদের নিকট আকুল আবেদন, যার যার অবস্থান থেকে মেয়র রাফিকা আকতার জাহানের অনৈতিক ভিডিও, কুকর্ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদে সোচ্চার হউন।
নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌর মেয়র রাফিকা আকতার জাহান বেবীর পদত্যাগ দাবীতে ১৪ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও তাদের এলাকার সুবিধা বঞ্চিত সহস্রাধীক নারী পুরুষ বিক্ষোভ মিছিল করেছে। মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) দুপুর ২ টায় পৌরসভা চত্বরে এই বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার ভিজিএফ এর চাল না পাওয়া হতদরিদ্র মানুষেরা।
জানা যায়, এবার ঈদুল ফিতর উপলক্ষে পৌর এলাকার দুঃস্থ অসহায় মানুষের জন্য ভিজিএফ এর চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪ হাজার ৬১৫ টি কার্ড। অর্থাৎ জনপ্রতি ১০ কেজি করে মোট ৪৬১৫ মেট্রিক টন চাল। যা ১৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ৫ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর এবং মেয়রের মধ্যে সমভাবে বন্টন করার কথা। এতে প্রতিজন কাউন্সিলর ন্যুনতম ২১৯ টি কার্ড পায়। কিন্তু মেয়র সম্পূর্ণ কার্ড কুক্ষিগত করে কাউন্সিলদেরর মাত্র ১০০ টি করে কার্ড দিয়েছেন। এর প্রতিবাদে ১৪ জন কাউন্সিলর কার্ড গ্রহণ করেননি। ফলে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের লোকজন ভিজিএফ এর চাল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। বাধ্য হয়ে ওইসব ওয়ার্ডের হতদরিদ্র মানুষগুলো চাল দেয়ার দাবীতে পৌরসভা সংলগ্ন পৌর কমিউনিটি সেন্টারে আসে। কিন্তু কার্ড না থাকায় তাদের চাল দেয়া হয়নি। এতে তারা নিজ নিজ ওয়ার্ড কাউন্সিলদের শরণাপন্ন হন। এরপর পৌরসভায় উপস্থিত পৌর কাউন্সিলররা জনগণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে চাল দেয়ার আহ্বান জানান। মেয়রের পদত্যাগ দাবী করে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। মিছিলটি পৌর চত্বর সহ পৌরসভা সড়ক প্রদক্ষিণ করে। শেষে কাউন্সিলররা বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, মেয়রের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তিনি প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে আমাদের ১৪ কাউন্সিলরকে কার্ড কম দিয়েছেন। আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের আমাদের অংশের কার্ড দিয়ে প্রকৃত অসহায় দরিদ্র মানুষকে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার থেকে বঞ্চিত করেছেন।
তারা আরো বলেন, মেয়র রাফিকা আকতার জাহান বেবী অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে পৌরসভার আয় তসরুপ করা সহ নানা দূর্নীতি করে চলেছেন। আর অবৈধ টাকার গরমে অসামাজিক কাজে লিপ্ত। যার ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার অশ্লীল ভিডিও পর পর দুই বার ভাইরাল হয়েছে। সর্বশেষ ছোট দেবর বুলুর সাথে অবৈধ দৈহিক সম্পর্কের ঘটনা ফাঁস হয়েছে। বুলুর স্ত্রীকে মারপিট করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এজন্য সেই গৃহবধূ দুই শিশুকন্যা সহ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে তার স্বামী ও পৌর মেয়রের মধ্যে পরকীয়ার ঘটনা তুলে ধরে সংবাদ মাধ্যমে ব্রিফিং করেছে। আমরা আবারও তার পদত্যাগ দাবী করছি।
উল্লেখিত অভিযোগ গুলো মেয়র রাফিকা আখতার জাহান বেবীর বিরুদ্ধে এনে তার পরিষদের ১৪ জন কাউন্সিলর বেশ কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করেন। অদৃশ্য সুতোর টানে আন্দোলনকারী কাউন্সিলররা হঠাৎ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারটি এখন পৌরবাসীর আলোচনার খোরাক হয়েছে !
এ ধরনের আন্দোলন নতুন নয় । এর পূর্বে আখতার হোসেন বাদল মেয়র থাকাকালিন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাউন্সিলরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ছিল। কিন্তু মরহুম আখতার হোসেন বাদল মেয়র নির্বাচিত হয়ে বর্তমান আধুনিক সবজি বাজার নির্মাণ করা সহ বিভিন্ন শহর উন্নয়ন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ করবে ঠিক তখন তার বিরুদ্ধে শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। তার বিরুদ্ধে পরিষদের কাউন্সিলরদের বড় একটি অংশ একের পর এক অভিযোগ তুলে দিনের পর দিন আন্দোলন করা সহ মেয়রকে অসহযোগিতা করেন। অসহযোগিতার ফলে আখতার হোসেন বাদল ঠিক ভাবে কোন কাজ করতে পারেনি। যেসব কাউন্সিলর তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ভিক্তিহীন অভিযোগ তুলে আন্দোলন করেন পরে তারা অদৃশ্য ঈশারায় আন্দোলন বন্ধ করে আখতার হোসেন বাদলের কাছে আসেন। কিন্তু তখন মেয়রের জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যর কোঠায় নেমে যায়। আর এই আন্দোলনে আখতার হোসেন বাদল হারায় জনপ্রিয়তা আর পৌরবাসী হয় উন্নয়ন বঞ্চিত। একই ঘটনা কি রাফিকা আখতার জাহান বেবীর ক্ষেত্রেও ঘটছে ?