ইসলাম ডেস্ক।। ব্রিটিশরা ১৭৮০ সালে Madrasah Education Board of Bengal স্থাপন করে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা শুরু করেছিল এই অঞ্চলে। একই বছর অবিভক্ত বাংলায়, কোলকাতাতে প্রথম আলিয়া মাদ্রাসা স্থাপন করেন ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস।
এটি তারা করেন তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই। তখনকার দিনে সরকারি সব আইন-কানুন, নথিপত্র লেখা হতো পারস্য ভাষায়। যেহেতু মুসলিম আইন গুলো আরবি ভাষাতে ছিল, তাই আরবি ভাষারও প্রচলন ছিল. সেই কারণে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরকার ছিল, যেখান থেকে ছাত্ররা একই সাথে পারস্য, আরবি এবং ইংরেজীতে পারদর্শী হয়ে বের হবে। তাই কোলকাতা আলিয়া মাদ্রাসাতে ধর্মীয় শিক্ষা তেমন গুরুত্ব না পেলেও, গণিত, দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা সহ অন্যান্য ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষার ওপরে যথেষ্ট জোর দেয়া হতো।
১৭৮১-১৮১৯ পর্যন্ত আলিয়া মাদ্রাসার বোর্ড অফ গভর্নরের সব সদস্যই ছিলেন ব্রিটিশ। ১৮১৯-১৮৫০ পর্যন্ত একটি নতুন বোর্ড অফ গভর্নরস দায়িত্ব পালন করেন একজন ব্রিটিশ সচিব এবং একজন ভারতীয় মুসলিম সহকারি সচিবের নেতৃত্বে। ১৮৫০ সালে প্রথম আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পদ সৃষ্টি করা হয়, এবং তাতে নিয়োগ পান ডক্টর স্প্র্যাঙ্গার. ১৮৫০-১৯২৭ পর্যন্ত আলিয়া মাদ্রাসার সব অধ্যক্ষই ছিলেন ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের. ১৯২৭ সালে, প্রথম একজন ভারতীয় মুসলিম, শামসুল উলামা খাঁজা কামালুদ্দিন, আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান।
এই দীর্ঘ ইতিহাসে, আলিয়া মাদ্রাসা জন্ম দিয়েছে অনেক মনীষীর: নবাব আব্দুল লতিফ, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী সৈয়দ আমির আলী, পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী চৌধুরী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, পূর্ব পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টার আতাউর রহমান খান এবং বিজ্ঞানী কুদরাত ই খোদা সহ আরও অনেকের।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর আলিয়া মাদ্রাসাকে কলকাতা থেকে ঢাকাতে স্থানান্তর করা হয়. ১৯৭১ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রমে বাংলা, ইংরেজি, অংক, বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকরণের এই প্রক্রিয়াকে একটি ছাঁচে ফেলে জবাবদিহিতার মধ্যে আনার উদ্দেশে, ১৯৭৮ সালে, সরকার Ordinance for the Modernization of Madrasah Education জারি করেন এবং স্থাপন করেন Madrasah Education Board.
এরপরও আলিয়া মাদ্রাসাগুলো, তাদের যে ঐতিহাসিক মূল লক্ষ্য – ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও ধর্মীয় জ্ঞানের এর সঠিক সমন্বয়ে যোগ্য মানুষ ও মুসলিম নেতৃত্ব গড়ে তোলা – সেটি থেকে অনেক খানিই সরে যায়। এর জন্য মূলত দায়ী, আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম কে যুগোপযোগী করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারে সরকারের অনীহা, উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব বিশেষ করে বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতির মত বিভিন্ন বিষয়ের বিবিধ শাখায়। যেই কারণে আলিয়া মাদ্রাসার বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীর জ্ঞানের পরিধি কোরান-হাদিস এবং আরবি ভাষায় দক্ষতার মধ্যেই সীমাবন্ধ থেকে যায়।
যদিও আলিয়া মাদ্রাসার ডিগ্রি মূলধারার সাধারণ শিক্ষার সমতুল্য, তা সত্ত্বেও আলিয়া মাদ্রাসা থেকে মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিশেষায়িত শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখনও অনেক কম. মূলধারার চাকরিগুলোতে ঢোকার ক্ষেত্রেও আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সমস্যার মুখে পড়তে হয়। Bangladesh Bureau of Educational Information and Statistics (BANBEIS) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ তে সারা বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার আলিয়া মাদ্রাসা ছিল. যেগুলোতে প্রায় ২৫ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করছিলো।
১৮৫৭ সালে দেওবন্দী আন্দোলনের সূচনা হয় ভারতের দেওবন্দ থেকে। এবং ১৮৬৭ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা স্থাপনের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শুরু হওয়া এই দেওবন্দী আন্দোলনের তিনটি প্রধান স্তম্ভ ছিল: মুসলিম (সুন্নি হানাফী মতবাদের) পুনর্জাগরণ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ভিত্তিতে স্বাধীন অবিভক্ত ভারতের প্রতিষ্ঠা. এরই ধারাবাহিকতায়, একটি সমান্তরাল ধারার মাদ্রাসা শিক্ষা শুরু হয় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে। ‘দেওবন্দী’ মতবাদের উপর ভিত্তি করে এদের পাঠ্যক্রমকে সাজানো হয়। সেই সময় এগুলো খারিজী (বেসরকারি) নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু পরে এই খারিজী মাদ্রাসা গুলোই কওমি মাদ্রাসা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এদের বৈশিষ্ট্য: এরা কোন সরকারি অনুদান নিতো না, সম্পূর্ণ ভাবে জনগণের দানের টাকায় চলতো, এবং মূলত ইসলামিক শিক্ষাকেই গুরুত্ব দিতো।
১৯৭১ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে, এই কওমি মাদ্রাসা গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার সাথে বাংলা এবং কিছু ইংলিশ ও গণিত শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭৮ সালে, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (Bangladesh Qawmi Madrasah Education Board) স্থাপন করে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি নীতিমালার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হয়। যদিও ৮০ শতাংশ কওমি মাদ্রাসা বেফাকের অধীনে, কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে প্রতিন্দন্দ্বিতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে সবগুলো কওমী মাদ্রাসাকে একটি বোর্ডের আওতায় আনা এখনো সম্ভব হয় নি।