প্রিমিয়ার ব্যাংক’র ৪৭৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ, পরিচালক স্বামী-স্ত্রী পালিয়েছে বিদেশে

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, স্টাফ রিপোর্টার।। রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে প্রিমিয়ার ব্যাংকের একটি শাখা থেকে ৪৭৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। রাজধানীতে ব্যাংকটির মহাখালি শাখায় এ দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে।

একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের ৭টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের অনুকূলে এ অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আর এতে ব্যাংকের তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপকের প্রত্যক্ষ সহায়তার তথ্য মিলেছে অনুসন্ধানে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যাংকটির মহাখালি শাখা হতে কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ৭টি প্রতিষ্ঠানের ফরেন বিল (ফরেন বিল এক ধরনের ঋণ রপ্তানিকারকদের তাদের রপ্তানি বিলের বিপরীতে এলসি এবং তাদের নগদ প্রবাহের সুবিধার্থে একটি চুক্তির বিপরীতে প্রদান করা হয়) ক্রয় করা হয়েছে।

এই ৭ প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যাংক শাখাটির অনেক লেনদেন নিজস্ব সফটওয়্যারের তথ্য ভান্ডারে সম্পৃক্ত না করার নজিরও পাওয়া গেছে।

এ সংক্রান্ত এক নথিতে দেখা যায় যে, ব্যাক টু ব্যাক এলসি মেয়াদ উত্তীর্ন হওয়ার পরও ভুয়া কাগজ দেখিয়ে এফডিবিপি সৃষ্টি করা হয়েছে। অবৈধ সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে দি প্রিমিয়াম ব্যাংকের তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক রানা আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ আবসারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের প্রমানও মিলেছে অনুসন্ধানে।

দেশের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটির (বিএফআইইউ) এক তদন্তে প্রিমিয়ার ব্যাংকের মহাখালি শাখা হতে যে ৭টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে ৪৭৮ কোটি টাকার অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে সেগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

বিএফআইইউ’র তালিকা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে; টিএনজি গ্রুপ, ফ্যালজিন ইন্টারন্যাশনাল নিট কম্পোসিট লিমিটেড, মেক্সিম এক্সপো এপ্যারেলস লিমিটেড, অলিম্পিক ফ্যাশন লিমিটেড, টিআরজি গার্মেন্টস ইন্ড্রাষ্ট্রিজ লিমিটেড, খান ফ্যাশন লিমিটেড এবং ডুক্যাটি এপ্যারেলস লিমিটেড।

এগুলোর মধ্যে টিএনজি গ্রুপকে অনৈতিক ভাবে ফোর্স ঋণ এমনকি বিল ক্রয়ের মাধ্যমে সমন্বয় দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদোত্তীর্ণ এলসির বিপরীতে ১০ কোটি টাকার ৩১ টি অ্যাক্সেপ্টেন্স দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি হতে তদন্তকালীন টিএনজি গ্রুপের পক্ষে ৩৮৬ কোটি ২৩ লাখ টাকার ১২৮৬টি এলসি খোলা হয়েছে।

যার মধ্যে ৯৯০ কোটি ১০ লাখ টাকার ৭৬০ টি ইনল্যান্ড ব্যাক টু ব্যাক এলসি। ‘ইনল্যান্ড ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি’ হলো একটি অর্থায়ন যেখানে একটি রপ্তানি কারক বিদেশী ক্রেতার দিকে থেকে একটি এলসি পেয়ে, সে এলসি ব্যবহার করে দেশীয় একটি ব্যাংক থেকে অন্য এলসি খোলে। একই এলসির বিপরীতে ফরেন বিল ক্রয় করে উক্ত অর্থ দিয়ে এইচপিএসএম এর ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।

এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে ২০২২ সালের ২৮শে জানুয়ারি ১৯ লাখ ৯৬ হাজার মার্কিন ডলারের এক্সপোর্ট এলসির বিপরীতে একই পদ্মতিতে এফডিবিপি ক্রয় করে উক্ত চলতি একাউন্টে স্থানান্তর করে এ্যাপ্রায়েল প্লাস লিমিটেডের ইডিএফ পরিশোধ করা হয়েছে। এর বাইরেও ওই ব্যাংক শাখা থেকে রপ্তানিকারকের সেলস কন্ট্রাক্টের বিপরীতে ৩৪৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার অনৈতিক প্যাকিং সুবিধা দেওয়া হয়।

যে সেলস কন্ট্রাকটের বিপরীতে রপ্তানি করার কোন নথি দিতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। একই ভাবে সেলস কন্ট্রাক্ট করে ১৬ আগস্ট ২০২১ বিপরীতে ৩৭১ কোটি ৪ লাখ টাকার সুযোগ করে দেওয়া হয়, যা পরে নগদ উত্তোলন করা হয়েছে। এই গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান বেসিক ক্লথিং লিমিটেডের ফোর্স লোনের বিপরীতেও ৫৪ লাখ ৯০ লাখ টাকার এলসি খোলা হয় ।

পরে রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবসিত হলেও ১৬ লাখ ৮৯ লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধ না করে ওই অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।

জানা যায়, টিএনজি গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহিদা হোসেন এবং তার স্বামী শাহাদাৎ হোসেন শামীমের নাম রয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। তারা এসব অর্থ বিদেশে পাচার করেছে, যা তদন্ত করলে সত্যতা মিলবে বলে দাবী একাধিক সুত্রের। তারা দুইজনই ৫ আগষ্টের পরে বিদেশ পালিয়ে গেছে। এর কারণে ওই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা বেতন পাচ্ছে না। শ্রমিকরা ঢাকা ময়মনসিংহ রাস্তা অবরোধ করেছিল। পরে বেতন পরিশোধের আশ্বাসে অবরোধ প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দেয়।

এ ব্যাপারে কথা বলতে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবু জাফরকে একাধিকবার কল দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেন নি। পরবর্তীতে ওয়াটস এপে মেসেজ দেওয়া হলে তিনি মেসেজ সিন করলেও রিপ্লাই করেন নি।

প্রসঙ্গত, প্রিমিয়ার ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখা হতে তিন হাজার কোটি টাকার ভুয়া ঋণ মঞ্জুর করে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগে প্রিমিয়াম ব্যাংকের চার কর্মকর্তাকে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আদালত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *