বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্যই যাঁদের জীবিকার উৎস

বিকাশ রায় চৌধুরী, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার।। ঘ‌রের বারান্দার এক কো‌নে ব‌সে বাঁশ দিয়ে কুলা, ঝুড়ি, চাটাই খৈ চালনা, টুকরিসহ গৃহ কাজের বাহারি পণ্য তৈরি কর‌ছি‌লেন শ‌র্মিলা বালা। ঠাকুরগাঁও সদ‌রের পূর্ব ফকদনপুর ঠান্ডিরাম কালিতলা গ্রামের বা‌সিন্দা শ‌র্মিলা বালা বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক এই পেশার অংশ হয়ে যান তিনি।

সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব পণ্য তৈরি করে স্বামীকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছেন। শ‌র্মিলা বালা বলেন, স্বামী রতন রা‌য়ের হাত ধরে এ পেশায় আসি। এটিই তাদের জীবিকা। ত‌বে প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতা আর দামের প্রতিযোগিতায় টিক‌তে না পে‌রে কদর কম‌ছে এ প‌ণ্যের।

এ‌তে সংসার ও সন্তানদের লেখাপড়া করাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তা‌ঁদের। জানা গেছে,শ‌র্মিলা বালার মত এ গ্রামটিতে বসবাস করে প্রায় ৮০‌টি পরিবার।

এসব পরিবারের শতাধিক নারী পুরুষ মূলত এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বংশপরম্পরায় চলে আসা এই শিল্প তাঁদের জীবিকার একটি উৎস। বাঁশের তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় এই সামগ্রী বিক্রির অর্থে চলে তাঁদের সংসার।

বাঁশের এসব পণ্য গ্রামীণ হাট ঘুরে চলে যায় জেলা শহরেও। তবে বাঁশ-বেতসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়েছে। আর চাহিদা বাড়ায় আমন ও বো‌রো মৌসু‌মে পণ্যের দাম বাড়ে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ।

কালিতলা গ্রামের বেতশিল্পের কারিগর বকুল দাস জায়গাজমি নেই, বসবাস করেন সরকারি খাসজমিতে। স্ত্রী, দুই মে‌য়েসহ চারজনের সংসার। এর আয় থেকেই সংসারের যাবতীয় খরচ চলে।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,বাপ-দাদার আমল থেকে এ পেশায় আছি। কিন্তু এই যুগে প্লাস্টিকের পণ্য বাজার দখল করায় আমাদের তৈরি পণ্য আর আগের মতো বাজ‌া‌রে চ‌লেনা ।

এ ছাড়া পণ্য তৈরির উপকরণের দাম বেশি। সুস্মা সরকার এই গ্রামেরই এক গৃহবধূ। স্বামী ক‌লিন রায়ের সঙ্গে তিনিও হাতে হাত মিলিয়ে ঝুড়ি, চাঁই, বাঁশ-বেতের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করেন।

এ প্রসঙ্গে সুস্মা সরকার বলেন, ছোটবেলা থেকেই ঝুড়ি, চাঁই, ধান-চাল রাখার গোলা, কুলা, ঢাকি, জালি তৈরি করছি। অভাব অনটনের সংসারে লেখাপড়া তেমন করা হয়ে ওঠেনি। এ গ্রামেই আমার বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে এসব পণ্যসামগ্রী তৈরি করি।

কিন্তু দিন দিন বাঁশের দাম অনেক বেড়েছে। যেখানে একটা বাঁশ ৫০-৬০ টাকায় পাওয়া যেত, এখন তা কিনতে হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। বড় সাইজের ১টি বাঁশ দিয়ে ১০-১২টি ঝুড়ি তৈরি করতে পারি। প্রতিদিন ১৪-১৫টি ঝুড়ি তৈরি করি।

এক একটি ঝুড়ি ১০০ থে‌কে ১৫০ টাকা বিক্রি হয়। প্রতি মাসে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা উপার্জন হয়। বিজন কুমার বেশ কয়েক বছর ধরে গুরুতর অসুস্থ। তার স্ত্রী অ‌ঙ্কিতা রানী এ ব্যবসার হাল ধরেছেন। ছেলেমেয়েরাও মাকে সহযোগিতা করে। অ‌ঙ্কিতার মতে,বাঁ‌শের তৈরির এ প‌ণ্যের উপকরণের দাম বেশি।

সে তুলনায় আমাদের পণ্যের দাম কম। খরচ বাদে যা আয় হয়, তা দিয়ে পণ্য তৈরির উপকরণ কিনব কী করে আর সংসারই বা চালাব কী করে! অন্য পেশার মতো সহজ শর্তে ঋণ ও সরকারি ভর্তুকি পেলে একটু ভালোভাবে চলা যেত।

প‌রি‌বেশবান্ধব বাঁশের পণ্যের চাহিদা কমার পেছনে যথাযথ ব্র্যান্ডিং না হওয়াকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন ঠাকুরগাঁও সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর মনতোষ কুমার দে।

তি‌নি দৈনিক আজকাল বাংলাকে ব‌লেন,পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত বাঁ‌শের তৈ‌রি এই পণ্যকে সহজে বৈশ্বিক পরিচিতি ও রপ্তা‌নিমু‌খি না‌ করার কার‌নে বাঁশ ও বেতের কুঠির শিল্প হা‌রি‌য়ে যেতে ব‌সে‌ছে।

ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবু বক্কর সিদ্দিক ব‌লেন, প্রতিযোগিতার টিকে থাকার দৌড় নয় বরং কুটির শিল্পকে শিল্প হিসেবে এবং এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে প্রণোদনা দি‌য়ে এ‌গি‌য়ে আস‌তে হ‌বে সং‌শ্লিষ্ট‌দের। পাশাপা‌শি এই শিল্পে‌র স‌ঙ্গে জ‌ড়িত‌দের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এবং শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।

সরকার যদি এটিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় তাহলে এই শিল্পটা দীর্ঘমেয়াদী টিকে থাকবে ‌। এবং এ অঞ্চলের জীবনমান উন্নয়নে এই শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ঠাকুরগাঁও বিসিক শিল্পনগরীর উপ-ব্যবস্থাপক হা‌ফিজুর রহমান বলেন,বহির্বিশ্বে বাঁশের তৈরি পণ্যের চাহিদা বাড়‌ছে। এই শিল্প সংশ্লিষ্টদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ালে বাঁশের তৈরি পণ্য রপ্তানিরও সম্ভাবনা রয়েছে। যদি কেউ কোনো ঋণ বা আর্থিক সহযোগিতার জন্য আসেন, তাহলে অবশ্যই আমরা তাকে সহায়তা করবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *