টেকনাফে সম্রাট ইয়াবা বদির ক্যাশিয়ার জাফরের কুকীর্তি!

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার।। কক্সবাজারের সীমান্ত জনপদ টেকনাফের ইয়াবা বদির ম্যানেজার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি ও টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর র‌্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক কাহিনী।

১লা নভেম্বর শুক্রবার রাত ৩ টার সময় ঢাকাস্থ পূর্ব বাসাবো এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-১৫ এবং র‌্যাব-৩ এর যৌথ আভিযানিক দল জাফর আহম্মদকে গ্রেফতার করা হয়। কক্সবাজারের টেকনাফ পুরাতন পল্লানপাড়া, ২নং ওয়ার্ড এলাকার মৃত সুলতান আহম্মদের ছেলে। তাকে টেকনাফ থানায় সোপর্দ করেছে র্যাব। র‌্যাব-১৫ জানিয়েছে, টেকনাফের ভয়ংকর ইয়াবা সিন্ডিকেটের ডন মাদক সম্রাট ইয়াবা বদির ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিল সাবেক আলোচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মাফিয়া জাফর।

টেকনাফ সহ সারা দেশে ভয়ংকর ইয়াবার বিস্তার ঘটিয়ে বদি পেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক গডফাদারের খেতাব আর সেই ইয়াবা সাম্রাজ্য সামলানোর দায়িত্বে ছিল তার সেনাপতি মাফিয়া জাফর। গত ১৭ বছর সংসদ সদস্য থাকাকালে ইয়াবা বদি নিজের নির্বাচনী এলাকা টেকনাফকে পরিণত করেছিলেন মাদক, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যার স্বর্গরাজ্যে। আর সেই স্বর্গরাজ্য কার্যক্রমের বিশ্বস্ত সহচর ছিল মাফিয়া জাফর। র‌্যাব জানায়, গত ২৯ শে মে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বদি ম্যাজিকে দ্বিতীয় বারের মতো উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জাফর। সরকার পতন হলে ১৯ আগস্ট দুই মাসের মাথায় স্বপদ হতে তাকে অপসারিত করা হয়।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রদের বিরুদ্ধে সকল হামলা ও কুকীর্তির নেতৃত্বে ছিলেন এই জাফর। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরপর টেকনাফের ঝর্নাচত্বর এলাকায় ছাত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায় জাফরসহ তার তিন সন্তান দিদার, শাহজাহান ও ইলিয়াস। হামলার সময় তার তিন সন্তানদের হাতে দুটি শর্টগান ও একটি পিস্তল দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।

গত ১৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা হত্যাচেষ্টা মামলার অন্যতম আসামি এই মাফিয়া জাফর। এই মামলার প্রধান আসামি ইয়াবা গডফাদার বদি ইতোপূর্বে র‌্যাবের হাতে আটক হলেও তার বিশ্বস্ত সহযোগী জাফর এতদিন অধরাই ছিল। র‌্যাব তাকে গ্রেপ্তারের জন্য সব সময় সচেষ্ট ছিল। অবশেষে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির মাধ্যমে তাকেও গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।

কক্সবাজার র‍্যাব-১৫ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ল’ অ্যান্ড মিডিয়া কর্মকর্তা) মো. কামরুজ্জামান জানান, সরকার পতনের জের ধরে গত ৫ আগস্ট রাতে টেকনাফে বিএনপি নেতার মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জাফরের নেতৃত্বে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট এর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এসব ঘটনায় পৃথকভাবে তিনটি মামলার দায়ের করা হয়েছে; যার প্রায় সবকটিতেই মাফিয়া জাফরকে আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলোর এজহার সূত্রে জানা যায়, টেকনাফের আলো শপিং কমপ্লেক্স, হোটেল নাফ কুইন ও আব্দুল্লাহ ব্রাদার্স ফিলিং স্টেশনে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট এর ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে জাফর ও তার ছেলেদের নেতৃত্বে। ইয়াবা বদির অপরাধ জগতের বিশ্বস্ত সহচর জাফর প্রথম জীবনে ছিলেন পান বাজারের শ্রমিক। সেখান থেকে হয়ে উঠেন শ্রমিক নেতা নামধারী দুর্ধর্ষ চাঁদাবাজ।

এই চাঁদাবাজির অর্থে সে টেকনাফ সদরের সদস্য নির্বাচিত হয়। এরপর থেকে তার আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর কৌশলে বিএনপি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে টেকনাফ সদর ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যান তিনি। কালের পরিক্রমায় জাফর নানারূপে আবির্ভূত হয়ে ইয়াবা বদির বিশ্বস্ত হাতিয়ার হয়ে মাদক সাম্রাজ্য সম্প্রসারনপূর্বক অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। কক্সবাজার র‍্যাব-১৫ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ল’ অ্যান্ড মিডিয়া কর্মকর্তা) মো. কামরুজ্জামান আরও জানান, বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় জাফর গ্রেফতার হলে কারাগারে ইয়াবা বদির সাথে তার সব সখ্যতা গড়ে ওঠে।

এরপর সে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদ বাগিয়ে নেন এবং বদির কারিশমায় চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। এরপর জেলা পরিষদ সদস্য ও ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আবারো উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।উক্ত নির্বাচনে ইয়াবা বদি ও জাফরের বিরুদ্ধে ভোট ক্রয়, ভোট চুরি সহ ব্যালট পেপার ছিনতাই এর অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে ইয়াবা বদি তার সেনাপতি জাফরকে নিয়ে সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফকে মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছেন। র‍্যাব-১৫ জানায়, জাফরের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র, দুদকের মামলা সহ রয়েছে প্রায় এক ডজন মামলা।

কয়েকটি মামলায় সে জামিনে থাকলেও অধিকাংশ মামলাই বিচারাধীন। ২০২১ সালের ২১শে জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা এক মামলায় বিপুল পরিমাণ আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। এছাড়াও সরকার পতনের জের ধরে দায়ের হওয়া নাশকতা মামলা গুলোতে সে এতদিন পলাতক আসামি ছিল এবং গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন স্থানে ছদ্মবেশ ধারণ করে আত্মগোপনে ছিল। কক্সবাজার র‍্যাব-১৫ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ল’ অ্যান্ড মিডিয়া কর্মকর্তা) মো. কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হল টেকনাফ স্থলবন্দর।

ইয়াবা গডফাদার বদি ছিল এই বন্দরের একক নিয়ন্ত্রক। আমদানি-রপ্তানি সেবা দানকারী সিএন্ডএফ এজেন্সি গুলো বদির কথার বাইরে যেতে পারত না। বিশ্বস্ত সহচর জাফর কে উস্তাদ বলে সম্বোধন করতেন বদি, যার জিম্মি ছিল বন্দরের প্রতিটি ব্যবসায়ী।

বদি ও জাফরের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন এজেন্সি গুলোর বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও বন্দর কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি, প্রতি ট্রাকে চাঁদা উঠানো সহ ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে অর্থ আত্মসাৎ এর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। র‍্যাব-১৫ এর ল’ অ্যান্ড মিডিয়া কর্মকর্তা আরও জানান, জাফর তার ছেলে মোস্তাক আহমেদ, দিদার হোসেন, মোঃ শাহজাহান, ভাই নজরুল ইসলাম ও এলাকার কতিপয় ইয়াবা কারবারিদের মাধ্যমে সামলাচ্ছেন টেকনাফের রমরমা ইয়াবা ব্যবসা।

এসব ব্যবসার মাধ্যমে সে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছে। জাফর ও তার ছেলেদের ভয়ংকর মাদকের থাবায় টেকনাফের যুবসমাজ হুমকির সম্মুখীন। ইয়বা সিন্ডিকেট ধরে রাখতে তার পরিবারের নির্মমতা ও বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্থানীয় অনেক এলাকাবাসী। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ১,২৭৫ জন মাদক কারবারিকে তালিকাভুক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে ইয়াবা বদি ও তার ঘনিষ্ঠ সহচর জাফর কে ইয়াবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের মূল কারিগর হিসেবে ধরা হয়।

অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে চিহ্নিত শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফরের নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে পুরো দমে ইয়াবা ব্যবসা অব্যাহত রেখেছে। ২০১৯ সালে আত্মসমর্পণকারী মাদক কারবারীরা পুনরায় জামিনে বের হয়ে জাফরের নেতৃত্বে আবার সঙ্গবদ্ধ হয়েছে এবং ইয়াবা ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *