
এস এম আওলাদ হোসেন, সিনিয়র রিপোর্টার।। লক্ষ্মীপুরে গতকালের তুলনায় বন্যার আরও অবনতি হয়েছে। পরিস্হিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্মারনকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে থাকা জেলার ৫টি উপজেলার বেশিরভাগ এলাকার মানুষ। পানিবন্দি হয়েছে অন্তত ৮ লাখ বাসিন্দা।
প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। চারদিকে এখন বানভাসি মানুষের হাহাকার। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে ত্রাণ ও সুপেয় পানির সংকট।
এদিকে লাহারকান্দি উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে অসুস্থ হয়ে আজ সোমবার ভোরে আবদুল মালেক নামে এক ব্যক্তি মারা গেছে। এর আগে রোববার বাড়ি থেকে পরিবার ও পরিজন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র যান আবদুল মালেক। বিষয়টি নিশ্চিত করেন পৌরসভার ১২ নম্বর কাউন্সিলর রাজু পাটোয়ারী।তিনি বলেন, ঠাণ্ডাজনিত কারণে আবদুল মালেক মারা যান।
এলাকাবাসী ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ২০ বছরের পর এতো পানি আর জলাবদ্ধতা দেখেনি লক্ষ্মীপুরের মানুষ। টানা ভারি বর্ষণ ও মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে একের পর এক গ্রাম শহর ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যায়।
তবে আকস্মিক বন্যার কবলে পড়ে সর্বপ্রথম প্লাবিত হয় রামগতি ও কমলনগর উপজেলার ৪০টি এলাকা। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য উপজেলায় প্লাবিত হয়। গত তিন দিন ধরে ফেনী ও নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালী ও ডাকাতিয়া খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরে ঢুকে পড়ছে।
বিশেষ করে ৫টি উপজেলা, চারটি পৌরসভা ও সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের বশিকপুর,মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, বাঙ্গাখাঁ, লাহারকান্দি ও উত্তর জয়পুরসহ ৪০টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রায় ৪ থেকে ৬ ফুট পানিতে ডুবে আছে জনপদ।
এতে করে সরকারি হিসেবে ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা আরও বেশি। ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকেই শিশু সন্তান নিয়ে ছুটছেন আত্মীয়-স্বজন ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশ্রয়ণ কেন্দ্রগুলোতে। এখন পর্যন্ত ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
গত শুক্রবার বিকেল থেকে জেলার অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা বন্যার্তদের মধ্যে শুকনো খাবার, চাল-ডাল, সুপেয় পানি ও ঔষুধসহ নানা সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন।
কিন্তু তা অপ্রতুল। আবার অনেক এলাকায় বেশি পানি থাকার কারণে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে বশিকপুর ইউনিয়নে বালাশপুর, রামনগর, নন্দীগ্রাম, ফতেধর্মপুর, শেরপুর, রশীদপুর গ্রামে পানি বেশি থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে করে চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর জন্য দাবি জানিয়েছে পানিতে আটকে থাকা বাসিন্দারা।
অভিযোগ করে অনেকেই বলেন, কয়েকদিন যাবত পানিবন্দি হয়ে পড়ে আছেন। পানি ওঠার কারণে ঘরে রান্না জুটছে না। খাওয়া-ধাওয়া করা যাচ্ছে না। এখনও কোনো ত্রাণ পাননি। খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছি। কাজ কর্ম করা যাচ্ছে না। মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। দুশ্চিন্তায় রয়েছে। যেভাবে পানি বাড়ছে, কোথাও যাবে, সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। পৌর আইডিয়াল কলেজে আশ্রয় নেওয়া শাহিনুর বেগম জানান, গত তিন দিন ধরে বাড়িতে পানি ওঠার কারণে আশ্রয় নিয়েছি। তবে যে পরিমাণ ত্রাণ দেওয়া হয়, সেটা অপ্রতুল। একইভাবে কথা হয়, প্রতাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া নুরনবী, আবদুর রহিম ও পারুল বেগমের সঙ্গে। স্বপ্না বেগম নামের এক নারী বলেন, ঘরবাড়ি সব ডুবে গেছে। ঘরের ভেতরে বুক পরিমাণ পানি উঠেছে। কিছুই আনতে পারিনি। শুধুমাত্র সন্তানদের নিয়ে কোনোরকম আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু খাওয়া-ধাওয়া অনেক কষ্টের। রান্না করা যাচ্ছে না।
অপরদিকে সদর উপজেলার দিলশাদপুর এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হোসেন বলেন, ‘চারদিকে শুধু পানি আর পানি। কোথাও বের হওয়ার মতো অবস্থা নেই। চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছি। টয়লেট না থাকায় শিশু সন্তানসহ বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছি। লক্ষ্মীপুরে রামগতি আবহাওয়া সতর্কীকরণ অফিসে কর্মকর্তা সৌরভ হোসেন বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৮০ মিলিমিটার। বন্যার অবনতি হচ্ছে। আরও বৃষ্টি কয়েকদিন থাকবে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাহিদ উজ জামান বলেন, রোববারের চেয়ে পানি এক ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। গত তিন দিন ধরে পানি অনেক বাড়ছে। বন্যার আরও অবনতি হচ্ছে। জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বন্যার অবনতির কথা স্বীকার করে বলেন, শনিবার পর্যন্ত সাড়ে ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। তবে সে সংখ্যা আরও বাড়বে। পাশাপাশি ১৮৫টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ৬৬টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এরই মধ্যে প্রায় ২০ হাজারের মতো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। অন্যদের উদ্ধারে কাজ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ৫৭৬ মেট্রিক টন চাল, নগদ প্রায় ১১ লাখ টাকা, শিশু ও গো-খাদ্যের বরাদ্দ পাওয়া যায়। সেগুলো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হচ্ছে। আরও বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। সবাই মিলে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা হবে।